সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে

বাড়ি প্রতিবেশীদের ভীড়ে একেবারে ঠাসা। পাড়ার বউ আর বয়স্কা নারীদের ভীড়ে ঠিক মতো চলাফেরা করা যায় না। বিরক্তি হচ্ছে, কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারছি না।বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে। তাছাড়া আজ আমার মেয়ের পাকা দেখা বলে কথা। আজ ছেলের পক্ষ মেয়ের সম্বন্ধে পাকা কথা বলবেন এবং সেই সঙ্গে দেনা পাওনার কথাও পাকা হবে।
দেনা পাওনার ভয়ে আমি মনে মনে বেশ চাপে আছি। আর চাপেই বা থাকবো না কেন বলুন? আমি সামান্য একজন মানুষ। বাড়িতে বিঘে চারেক ধান জমি আর মাছ ধরার একটি ছোট নৌকা আছে। ধানি জমি থেকে মোটামুটি সাত জনের বছরের ভাত বছরে হয়ে যায়।আর নৌকা থেকে স্বামী স্ত্রী মিলে যা রোজগার করি তাতে সংসারের অন্যান্য খরচ করেও কিছু সঞ্চয় করতে পারি। কিন্তু যেটুকু সঞ্চয় হয়, তাতে কিছুতেই তিন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তাই আজ আমার বড় মেয়ের পাকা দেখাতে একটু চাপে থাকতে হবে বৈ কি?
আমার মেয়ে যখন সেজে বের হল, তখন তাকে আমি চিনতে পারি নি। এই কি আমার মেয়ে শর্মিলা? না অন্য কেউ! যেন দূর্গা প্রতিমা! মা দশভূজা যেন স্বর্গলোক থেকে এই মর্তলোকে আবির্ভূতা হয়েছেন। মেয়েকে না পছন্দ করে পারবে না। তবে সুন্দরের জন্য কি দাবি দাওয়া একটু কম করবে পাত্রপক্ষ। মনে তো হয় না এরা দেনা পাওনা কম করবে।
বিকাল চারটায় দেনা পাওনার কথা শুরু হলো। পাত্রের বাবা বললেন- আপনার মেয়ে তো একেবারে মা দশভূজার প্রতিরূপ। এমন মেয়েকে আমরা হাত ছাড়া করব না। আমাদের ছেলেকে মা লক্ষ্মীর পছন্দ হলে বাকী কাজ আমরা এগোতে পারি। আমি আগেই মেয়ের অনুমতি নিয়ে বসেছিলাম। বললাম- আপনাদের ছেলেকে মেয়ের পছন্দ হয়েছে। আপনারা কথা এগোতে পারেন।
তখন পাত্রের মামা বললেন- বিনয়বাবু, কথা আর এগোনোর কি আছে? আপনার মেয়ে সুন্দরী, পড়াশুনাও বেশ খানিকটা আছে। সেই তুলনায় আমাদের ছেলে দেখতে তেমন ভালো নয়। তাছাড়া পড়াশুনাও তেমন কিছু করে নি। শুধু বিদেশে কয়েকবার গিয়ে বেশ কিছু টাকা করেছে, ভালো বাড়ি একখানা বানিয়েছে, বেশ কয়েক বিঘা জমি জিরেতও করেছে। তাছাড়া কাকদ্বীপের বাজারে একটি ভালো স্টেশনারী দোকানও করেছে। সেই দিক দিয়ে কিছু না দিলে কেমন হয়। আপনারা মেয়ের হাতে কানে আর গলায় এই তিন থান এবং ছেলের হাতে গলায় দিলেই চলবে। তবে ছেলের কোন স্পেশাল দাবি আছে কি না আমার জানা নেই। সেটা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেই হবে।
এমন সময় ছেলে বললে- আমাকে গলায় আর হাতে আংটি ছাড়া একটি মোটর বাইক দিতে হবে। বাইকটি হতে হবে রয়াল এনফিল্ডের। গলায় যেন মোটা স্পাইরাল চেন হয়। আমি পাত্র পক্ষের দাবি শুনে অবাক হলাম। আমার পক্ষে এই দাবি দেওয়া কিভাবে সম্ভব! আমি খুব বেশী হলে মেয়ের তিন থান আর ছেলের মাঝারী ওজনের দুই থান গহনা দিতে পারি। কিন্তু বাইক দেওয়া কিছুতেই সম্ভব না। আমার তেমন সামর্থ্য নাই। আমি আমার স্ত্রী সঙ্গে আলোচনা করলাম। আলোচনা হলো যে মেয়ের তিন থান এবং ছেলের দুই থান কোন রকমে মাঝারী মানের গহনা দেওয়া হবে। কিন্তু বাইক দিতে পারবো না। কিন্তু ছেলে কিছুতেই বাইক ছাড়া বিয়ে করবে না।
আমি প্রায় বিয়ের পাকা দেখা ভেঙে দিতে চাইছিলাম। এমন সময় আমার স্ত্রী শকুন্তলা বললে যে ছেলেকে বাইক দেওয়া হবে। ফলে বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেল। পাত্র পক্ষ বিয়ের দিন তিথি ইত্যাদি নিরূপণ করে বিকাল পাঁচটায় কব্জী ডুবিয়ে টিফিন খেয়ে যে যার পথে বাড়ি গেলো।
সবাই চলে গেলে বাড়ি খালি হলো। আমি গিন্নির উপর চোটপাট করতে লাগলাম। বললাম-তুমি বাইক দেবার জন্য রাজি হলে কেন?
-স্ত্রী বললে-এমন ছেলে হাতছাড়া করতে চাই না বলে?
-ছেলে বা ঘর ভালো। কিন্তু আমার সামর্থ্যের কথা ভাবতে হবে তো?
- তুমি কি কি দিতে চেয়েছিলে মেয়েকে?
-ঐ তো মেয়েকে তিন থান এবং ছেলেকে দুই থান জিনিষ। এছাড়া খাট গদি থালা বাসন আলমারি আলনা কাপড় চোপড় ইত্যাদি তো আছেই। সব মিলিয়ে লাখ চারেকের খরচ। তার উপর বাইক দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি আমায় জিজ্ঞাসা না করে কেন বাইক দেবে বললে!
-বাইকের কথা তোমায় ভাবতে হবে না। বাইকের খরচ শুধু নয়, তোমার মেয়ের গহনার খরচও আমি কিছু দেবো। চিন্তা করো না। এমন ঘর হাত ছাড়া করা যায় না। এখানে আমার মেয়ে সুখেই থাকবে। সুতরাং চিন্তা না করে আমাদের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
-বললাম- তুমি কি পাগল হয়েছ! রয়াল এনফিল্ড বাইকের দাম কত জানো। মিনিমাম এক লক্ষ টাকা দাম হবে।তুমি কি একে খেলনা ভাবলে?
-না মশাই, একে আমি একেবারে খেলনা ভাবি নি। আমি বাইকের দাম ভালো করেই জানি। বরং তোমার থেকে বেশী জানি।
-তাহলে তুমি এত টাকা পাবে কোত্থেকে! তুমি কি কোন গুপ্তধন পেলে নাকি?
-মোটেই গুপ্তধন পাইনি। তবে নিজে গুপ্তধন গড়েছি।
-সে কি রকম?
এবার আমার বউ আমার হাতে দুটি পাশবই দিল। তার একটি গ্রামীন ব্যংকের এবং অপরটি পোষ্ট অফিসের। বই খুলে দেখি গ্রামীন ব্যাংকে আছে আড়াই লাখ টাকা আর পোষ্ট অফিসে আছে লাখ দুয়েক টাকা!!! মোট সাড়ে চার লাখ টাকা সঞ্চয়!! আমার কাছে আছে মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকা। কিন্তু এত টাকা শকুন্তলা জমালো কিভাবে?
-বললাম- তুমি এত টাকা জমালে কি ভাবে?
-আর যাই করি অসৎ উপায়ে সঞ্চয় করি নি।
-আমার মেজাজ গেল বিগড়ে। আমি বললাম - আমি কি তাই বলেছি?
-স্ত্রী হেসে বললে-দেখ, রাগ কর না। আমি তোমার পয়সা জমিয়ে এই সঞ্চয় করেছি। অবশ্য কিছুটা আমার পরিশ্রমের টাকাও আছে।
-কি রকম শুনি?
-শোন, প্রতিদিন রান্নার সময় যে চাল নেওয়া হয়, তার থেকে একমুঠো করে চাল তুলে নিয়ে একটি কলসিতে রেখে দিতাম। সকলের ভাগ থেকে একমুঠো চাল তুলে নিলে এমন কিছু হবে না।প্রতিদিন দু'শ গ্রাম চাল জমে মাসে প্রায় ছ'কেজি চাল জমতো। সেই চাল আমি বিক্রি করে পেতাম এক'শ কুড়ি টাকা। ঐ টাকা আমি পোষ্ট অফিসে জমা দিতাম। তারপর বাড়ির হাঁসের দিম, মুরগীর ডিম বাড়িতে খাওয়ার পরও বাকি ডিম বাঁচিয়ে বিক্রি করে দিয়ে সেই পয়সাও পোষ্ট অফিসে জমিয়েছি। পরে এক'শ দিনের কাজের সুযোগ এলো। তখন গ্রামীন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা হলো। এক'শ দিনের কাজ করে যা রোজগার করেছি, সবই ব্যাংকে জমা আছে। এছাড়া গ্রুপ থেকে টাকা লোন হলে আমার ভাগের টাকা গ্রুপের অন্য সদস্যরা সুদের বিনিময়ে নিয়ে নিত। ঐ সুদের টাকাও এই গ্রামীন ব্যাংকে জমিয়েছি। আজ ষোল বছরে অক্লান্ত চেষ্টায় ওই টুকু টাকা জমাতে পেরেছি। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কি শুধু তোমার! আমার কি কোন দায়িত্ব নেই?
-আমি এদিক ওদিক দেখলাম। দেখি কাছে পিঠে কেউ নেই। আমি বউকে জড়িয়ে ধরে তাকে একটা চুমু খেয়ে বললাম- সত্যি, সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে!
-সঙ্গে সঙ্গে বউ আমাকে দূরে ঠেলে দিয়ে ভেঙচি কেটে বললে-বুড়ো বয়সে আর আদিখ্যাতা করে লাভ নেই। আমার আর কি গুন আছে!! যত গুন তো তোমার মায়ের আছে! আমরা হলাম লক্ষ্মীছাড়ী ঘরের বউ।
বউয়ের কথায় আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। বউরা যে কেন মায়ের উপর শত্রুতা করে বুঝি না বাবা। বউ ভাবে স্বামী তার সম্পত্তি। তাই সে তার সম্পত্তি দখলে রাখতে চায়। আর মা ভাবে ছেলে তার সম্পত্তি। তাই সেই সম্পত্তি কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না। মাঝখানে আমরা ছেলেরা পড়ি যাঁতাকলে। যাক মায়ের কথা পরে ভাবা যাবে। এখন বউকে বেশী দরকার। তাই বউয়ের পিছন পিছন ধাওয়া করলাম।
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
দেবনগর
২রা মে, ২০২১ খ্রীঃ

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.