#খুড়োর_আষাঢ়ে_গল্প

পঞ্চানন খুড়োর কাছে গল্প শুনবো বলে দুপুরে আমশোল দিয়ে ভরপেট ভাত খেয়ে খুড়োর কাছে উপস্থিত হয়েছি। বোশেখের মাঝামাঝি সময়ে খুড়ো তখন তার খড়ের বাড়ির দালানে বসে দখিনা বাতাসে হুঁকো খাচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই খুড়ো মুচকি হেসে বললেন- কি ব্যাপার ভাই-পো খবর কি?
আমি হেসে বললাম- খবর তো একটাই খুড়ো। তা হলো তোমার কাছ থেকে গল্প শোনা। এই সময়ে গল্পটা ভালো জমবে। একটা ভালো দেখে গল্প শোনাও দেখি!
খুড়ো বললে- গল্প শুনবি? তাহলে আমাকে বিছানাটুকু পাততে দে। সবে খেয়ে ধূপমান করেছি। আর বসতে ভালো লাগছে না।
খুড়ো তার বিছানা পাততে শুরু করলেন। প্রথমে একখানা পাঁচফুট বাই ছ’ফুট চ্যাটাই বিছিয়ে তার উপর একখানা মোটা কাঁথা বিছিয়ে দিলেন।এবার তার উপরে খুড়ো তার ষাট বছরের শীর্ণ শরীরটাকে বিছানায় খেলিয়ে দিলেন। খুড়োদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তিন ছেলে আর চার মেয়ে। সবার বিয়ে দিয়েছেন। আগে জমিজমা কিছু ছিল। কিন্তু চার মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে এখন একেবারে ফতুর হয়ে গেছেন। স্ত্রী গত বছর দুই গোলকধামে গেছেন। এখন একেবারে একা, নিঃসঙ্গ। তিন ছেলে ভাগাভাগি করে বাপের ভরণ পোষণের ভার নিয়েছে। এখন ছোট ছেলের বাড়িতে থাকেন। খুড়ো একেবারে কর্ম-শক্তিহীন। বাড়িতে হাঁস মুরগী লক্ষ্য রাখা আর তামাক খাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই। ফলে আমি গেলে খুড়ো কিছুটা স্বস্তি পান এবং আমার সঙ্গে গল্প করে তাঁর সময়টা বেশ ভালো কাটে।
যাইহোক খুড়ো বিছানায় শুয়ে আমাকেও বিছানায় শুতে বললো। আমি বিছানায় শুবো কি না চিন্তা করছিলাম। কারণ খুড়োদের বিছানার কাঁথা একেবারে নোংরা, বিছানা থেকে কি রকম একটা তেল চিট চিটে গন্ধ বেরুচ্ছিল। বালিশগুলোতে মাথার তেলের দাগ কালো হয়ে বসে রয়েছে! কি করবো ভাবছিলাম। তারপর সাতপাঁচ না ভেবে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। আমি শুতেই খুড়ো গল্প শুরু করলেন।
খুড়ো বললেন- শোন কৃষ্ণ, এই যে গল্পটা বলবো এটা একেবারে বাস্তব ঘটনা। ভাবিস না “গল্পের গরু গাছে উঠে”। যারা জ্যোতিষশাস্ত্র বোঝে তারা এই গল্পের বাস্তবতা স্বীকার করবেন।
খুড়ো বললেন- আমাদের বাড়ি তখন মেদিনীপুরের হেড়িয়াতে। সেখানে একটি পোড়ো বাড়িকে ভূতুড়ে বাড়ি বলেই সকলে জানতো। বাড়িটি ছিল গ্রামের শেষ প্রান্তের রাস্তার পাশে। বাড়িটির চারিদিকে ছিল আম কাঁঠাল আর নানা রকম ফলের বাগান। তখন পাকা বাড়ির অত চল ছিল না। সকলে মাটির একতলা দু’তলা বাড়ি বানাতো। অনন্ত মাইতি বলে এক ধনীলোক ঐ দু’তলা বাড়িটি বানায়। কিন্তু গৃহ প্রবেশের দিন থেকেই ভূতের তান্ডব শুরু হয়। দিন চারেক থাকার পর অনন্ত বাড়ি ছেড়ে আমাদের এই চব্বিশ পরগনায় এসে উকিলের হাটে বসবাস করতে শুরু করে। সেই বাড়ি ভূতুড়ে বলে কেউ কিনতেও চায় না।
একদিন পাড়ার ছেলেরা মিলে সেই বাড়িতে ক্লাব ঘর বানালো। তারা সেখানে রাতদিন আড্ডা দিতে থাকে। দেখি কেমন ভূত! কেমন করে তাদের জব্দ করে!
এবার আমি খুড়োকে প্রশ্ন করলাম-অনন্তবাবু পালিয়ে এলেন কেন? তিনি তো একবার গুনিন বা ওঝা নিয়ে ভূত তাড়ানোর চেষ্টা করতে পারতেন।
খুড়ো বললেন- সে করে নি আবার! অনেক গুনিন, ওঝা দেখিয়েও কোন লাভ হয় নি। সেই একই গন্ডগোল, একই ভয়ের কারন! কিছুতেই ভূত তাড়ানো গেল না বলে তিনি ঘরের মায়া ছাড়লেন।
কিন্তু ভুতের উপদ্রবটি কি ধরনের শুনি?
সেই কথাতেই আসছি। একটু ধৈয্য ধর। সবই বুঝতে পারবি। এই বলে খুড়ো আবার গল্পে ডুবে গেলেন। তিনি বলে চললেন- যে ছেলেরা সেখানে ক্লাব গড়ে তুললেন তাদেরকে অনন্ত কিছু বললেন না। তিনি জানতেন যে ঐ ভূতের অত্যাচারে ক্লাবটি ওখান থেকে পাততাড়ি গুটাবেই এবং হলোও তাই।
সেদিন ছিল রবিবার। ভারত ক্রিকেটে বিশ্ব চাম্পিয়ন হয়েছে। সেই আনন্দে সবাই ক্লাবে ভুরিভোজের আয়োজন করলো। সবাই সিদ্ধান্ত করলো যে ভোজের শেষে কেউ যাবে না। সবাই ক্লাবে থেকে যাবে। কারণ ভোজের সঙ্গে বিপিনবাবুর কিছুটা কারণ-সুধা শরীরে যাবে যে!তার সুবাস নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ। তাই ক্লাবে থাকাই যুক্তিযুক্ত।
সবাই ভোজে আনন্দ ফুর্তি করছে। এমন সময় আকাশে মেঘ উঠে ঝড়ের তান্ডব শুরু হলো। শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদকে অসূরাকৃতির একটি মেঘ গ্রাস করলো। ঠিক এমন সময় লোডশেডিংও হলো। এর ঘন্টা খানিক পর বিশ্ব চরাচরের প্রকৃতি শান্ত হলেও বাড়ির আশপাশ শান্ত হলো না। চারি দিকে শোঁ শোঁ বাতাস বইতে শুরু করে। বাড়ির চারিদিকে যেন শত শত মানুষের পদ শব্দ শোনা গেল। সেই পদ শব্দের সঙ্গে অসংখ্য কুকুর তার স্বরে চিৎকার করে উঠলো। এমন সময় এক অতিপ্রাকৃতিক স্বরে কেউ যেন বললো-” আমি কি এখন পড়বো? বলো না -আমি কি পড়বো?”
ক্লাবের সবাই অবাক! তাদের নেশা গেছে ছুটে। তারা পরিষ্কার বুঝলো এটা সেই ভূতের গলা। এমন পরিবেশে তো ভূতের আবির্ভাব হয়। এটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা সেই ঝড় বিদ্ধস্ত পরিবেশে প্রান বাঁচাতে যেদিকে পারলো ছুটে পালালো। সাপের ভয়, বাপের ভয় সব কিছুকে তোয়াক্কা না করে ছুটলো প্রান বাঁচাতে!
পরের দিন গ্রামের মাতব্বর লোকেরা একত্রিত হলো পাড়ার চন্ডীমন্ডপতলায়। অনন্তবাবুর ভূতুড়ে বাড়িটার একটা হেস্তনেস্ত না করলে নয়। বাড়িটা বড্ড বিপদ জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাল পাড়ার ছেলারা যেভাবে হেনস্তা হয়েছে, তাতে বাড়িটাকে ভেঙ্গে ফেলা ছাড়া উপায় নেই। তাই সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন যে অনন্তবাবুকে খবর দিয়ে আনাবেন এবং তার বাড়িটা ভেঙ্গে ফেলার জন্য বলবেন।
যথারীতি গ্রামের লোকের অভিযোগে অনন্তবাবু তার সাধের বাড়িটি ভেঙ্গে ফেললেন। বাড়িটির অস্তিত্ব হিসাবে ধ্বংসাবশেষ হিসাবে পড়ে রইলো মাটির দেয়ালগুলি।
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর গ্রামের লোকেরা একটি চোরকে তাড়া করলো। চোর বেচারী তাড়া খেয়ে অনন্তবাবুর ভাঙ্গা বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলো। যেহেতু মধ্য রাত্রি অতিক্রান্ত হয়েছে এবং চোর যখন ভূতুড়ে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তাই সবাই চোরকে ধরার আশা ত্যাগ করে যে যার বাড়িতে প্রস্থান করলো।
এখন সেদিন ছিল বকুল অমাবশ্যার রাত। চোর অর্থাৎ ঐ গ্রামেরই গরীব দিন মজুর সাধুচরণ মাইতি বাধ্য হয়ে বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ভাবলেন যে আজ সে কিছুতেই বাড়ি ফিরে যাবে না। আজ দু’দিন হলো তিনি দুই সন্তান আর স্ত্রীর মুখে দু’মুঠো অন্য তুলে দিতে পারেন নি। আজ মুখুজ্জেদের একখানা লাউ চুরি করতে এসে যেভাবে তাড়া খেলেন,তাতে আর তিনি এ জীবন রাখতে চান না। তাই এই পড়ো বাড়িতে ভূতের হাতেই প্রান দিতে চান।
সাধুচরণ বড় ঘরের মেঝেতে বসে এই সব কথা ভাবছিলেন। এমন সময় অতিপ্রাকৃতিক স্বরে দেয়াল বলে উঠলো-”আমি কি পড়বো?” বলো না -”আমি কি পড়বো?”
সাধুচরণ বললে- হ্যা, বাবা তুমি আমার মাথার উপরেই পড়ো। আমাকে শেষ করে ফেলো।
সাধুচরণের কথা শেষ হতেই তার মাথার উপর কি যেন পড়তে লাগলো। বেশ খানিকক্ষণ পড়ার পর তা আবার থেমে গেল। ততক্ষনে সাধুচরণ বুঝতে পারছে না যে কি তার মাথার উপর পড়ছে। একমুঠো হাতে তুলে নিতেই সে বুঝতে পারলো এবং তার অজান্তেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো একটি বাক্য-”একি! এ যে চাল! বেশ কয়েক মন চাল পেয়েছে সে!
আনন্দে আত্ম হারা হয়ে গেল সাধুচরণ। সে সের দুয়েক চাল গামছায় বেঁধে ঘন অন্ধকারে মিশে বাড়ি ফিরলো। পরে সাত দিন ধরে নিশুতি রাতে সেই বাড়ি থেকে কিছু কিছু করে সব চাল বাড়িতে নিয়ে এলো। কিন্তু কি আশ্চর্য্য! আর কোন রাতে এমন ঘটনা ঘটলো না। সে অপেক্ষা করলো পুর্নিমার রাতের জন্য। এলো সেই পুর্নিমার রাত। সাধুচরণ গুটসুটি মেরে সেই ঘরে বসে রইলো। কিছুতেই সাধুচরণের ঘুম এলো না। অবশেষে নিশুতি রাতে দেয়াল বলে উঠলো-” আমি কি পড়বো? বলো না- আমি কি পড়বো?”
অমনি সাধুচরণ বললো- হ্যা বাবা, তুমি আমার মাথার উপরেই পড়ো। সাধুচরণের কথা শেষ হতেই উপর থেকে পড়তে লাগলো শুধু সোনার মোহর। চন্দ্রালোকিত স্বচ্ছ শীতল আলোক রশ্মি মোহরের উপর পড়ে তার আলো চারিদিকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। মোহরবৃষ্টি শেষ হলে সব মোহর একটি থলেতে ভরে সেই নিশুতি রাতে অনেক কষ্টে বাড়িতে ফিরলো।
কয়েকদিন পর সাধুচরণ পরিবার নিয়ে চব্বিশ পরগনার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাল। উদ্দেশ্য চব্বিশ পরগনায় কিছুদিন থেকে মোহরগুলোর ব্যবস্থা করা এবং অনন্তবাবুর সঙ্গে দেখা করে চন্ডীপুরের ঐ বাস্তুভিটা কিনে নেওয়া।
পঞ্চাননখুড়ো গল্প শেষ করে আমাকে বললেন-কৃষ্ণ, তোর খুড়িকে বলে এক ছিলিম তামাক সাজিয়ে আন দেখি। নেশাটা বড্ড চাগাড় দিচ্ছে। আমি হুঁকো আর কল্কে নিয়ে খুড়ীর কাছে চললাম।
(এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক এবং কাহিনীর কোন চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের কোন চরিত্র মিলে গেলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়)
কপিরাইট@কৃষ্ণদ্বৈপায়ন
দেবনগর
২০শে এপ্রিল,২০২০।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.