#পথে_হলো_দেখা

আমি ইন্দ্রনীল সরকার। পেশায় পঞ্চায়েতের কর্মচারী। সে রকম ভাবে বলতে গেলে আমি পঞ্চায়েতের সেক্রেটারী। প্রতিদিনের মতো আমি সেদিন মঙ্গলবার অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি দ্বিচক্রযানে অর্থাৎ স্কুটিতে। আপন মনে স্কুটি চালাচ্ছি। ন্যাশন্যাল হাই ওয়েতে স্কুটি চালাচ্ছি তো। তাই খুব মনযোগ দিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। একটু এদিক ওদিক হলেই দেওয়ালে ছবি হয়ে থাকতে হবে।
হঠাৎ এক মহিলা আমায় থামালেন। বললেন- আমায় একটু লিফট দেবেন। করোনার জন্য রাস্তায় গাড়ি নেই। অথচ আমাকে বাপের বাড়ি যেতেই হবে। মা যে খুব অসুস্থ!
মায়ের কথা শুনে আর না বলতে পারলাম না। অথচ বাড়িতে বারণ ছিল যে আমি যেন এই করোনার আবহে কেরিয়ারে কাউকে না তুলি। কিন্তু মায়ের বিপদের কথা শুনে, বাড়ির কথা অগ্রাহ্য করতে বাধ্য হলাম। বললাম- আপনি যাবেন কোথায়?
-আজ্ঞে নামখানা।
- তাহলে ঠিক আছে। আমি নামখানাতেই যাবো। বলে মহিলাকে স্কুটির পিছনে বসতে বললাম। মহিলা স্কুটিতে বসতে আসতেই, তাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। ওকে দেখেই আমি চমকে উঠলাম। আরে এ যে মাধুরী! যার ভালোবাসায় পাগল ছিলাম আমি। শুধু জাতিগত ভেদাভেদের জন্য সেই প্রেম পূর্নতা পায় নি।
-আমি বুঝতে পারলাম যে আমার মধ্যে বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে বলে মাধুরী আমায় চিনতে পারে নি। কিন্তু এতদিন পর দেখা বলে ওর কথা, ওর পরিবারের কথা জানতে ইচ্ছে করছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমরা যে দু’জন দু’জনকে ভালো বাসতাম সে কথা কেউ কোন দিন পরষ্পরকে বলি নি। কিন্তু এই ভালোবাসার প্রতি চোখের ইশারায় সমর্থন ছিল। তাই আজ এতদিন পর দেখা হওয়ায় এবং আমার স্কুটির আরোহী হওয়ায় আজ বড় জানতে ইচ্ছে করছে যে সত্যি আমাকে মাধুরী ভালোবাসতো কিনা। আমি তো ভালোবাসতাম। কিন্তু দারিদ্র আর জাতিগত ভেদাভেদের ভয়ে সে কথা মাধুরীকে বলতে পারিনি। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, মাধুরী আমার প্রতি মুগ্ধ ছিল।সেই মুগ্ধতা ছিল আমার জীবনের পরম পাওয়া।
-আজ তাই মাধুরীকে পরখ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। বললাম- নামখানায় আপনার কোথায় বাপের বাড়ি?
- নামখানার শিবনগরে আমার বাপের বাড়ি। বাবার নাম নরেন্দ্রনাথ মাইতি
-আমি সব জান্তার মতো বললাম- ও! আপনি নরেনবাবুর মেয়ে?
-আপনি উনাকে চেনেন?
-চিনবো না! আমার বাড়ি যে শিবনগরে! আপনার বাপের বাড়ি শিবনগর দক্ষিন পাড়া আর আমার বাড়ি শিবনগর উত্তর পাড়া।
-তাহলে আপনার নাম কি?
-বললাম আমার নাম বাসুদেব বেরা। ইচ্ছে করে ভুল নাম বললাম।
-উত্তর পাড়ার এক জন ছাড়া কাউকে আমি জানি না।
-কে সেই সৌভাগ্যবান?
- তার নাম ইন্দ্রনীল সরকার। কিন্তু সৌভাগ্যবান বলছেন কেন?
- সৌভাগ্যবান বলবো না? এতবড় পাড়ায় একজন সুন্দরী মহিলা একজন মাত্র পুরুষকে চেনে। তাহলে সেই পুরুষ সৌভাগ্যবান নয় কি?
-মাধুরী হেসে বললে- না, তেমন কিছু নয়। আসলে উনি আর আমি একসঙ্গে পড়তাম। তাই উনাকে চিনি।
-তাই বলুন। আমি ভাবলাম আপনি বোধ হয় উনাকে ভালো বাসতেন। তা না হলে একটি গরীব বাড়ির ছেলেকে আপনি চিনলেন কি করে? কিন্তু আপনার কথা শুনে আমার সেই ভুল ভেঙে গেল।
-মানুষ সব সময় তো গরীব থাকে না। এখন মনে হয় উনার অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে?
-তা ঠিক, এখন উনি ধনী হয়েছেন। পাড়ার সব চেয়ে ধনী ব্যক্তি।ভালো চাকরী পেয়েছেন না!
-কোথায় বিয়ে করেছেন উনি?
-ঐ তো কাকদ্বীপের কাছাকাছি একটি গ্রামে।
-ছেলে মেয়ে কয়টি?
-মনে হয় তিন মেয়ে। ছেলে নেই।
-হায় পোড়া কপাল! এ তো দেখি আমার মতো অবস্থা।
-মানে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
-মানে আমার দু’টি মেয়ে। পুত্র সন্তান নেই।
বললাম- কি আর করবেন বলুন। ঈশ্বর কপালে যা লিখে দিয়েছেন, তাই ভোগ করতে হবে। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম-কি করেন আপনার স্বামী?
-উনি কিছুই করেন না। বিঘে দশেক জমি আছে আমাদের। তাতেই আমাদের কৃষি কাজ করে দিব্যি চলে যায়।
কথা বলতে বলতে আমরা শিবনগর স্কুল বাজারে পৌছে গেলাম। মাধুরীকে আমি বাজারে তার দাদার দোকানে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
পরের দিন ছিল বুধবার। লকডাউনের জন্য অফিস যেতে হবে না। এখন সপ্তাহে দু’তিন দিন অফিস করলেই চলে। সোম মঙ্গল দু’দিন অফিস করেছি। আজ আর অফিস যাবো না। তাই সকাল আটটা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছি। এমন সময় ফোনের বিকট শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। স্ক্রিনে দেখলাম অজানা নাম্বার। আমি পঞ্চায়েতের সেক্রেটারী। তাই যে কেউ ফোন করতে পারে। ফোনটা তাই ধরলাম। অপর প্রান্ত থেকে সুরেলা নারী কন্ঠ ভেসে এলো। বললো-কি গো আমাকে বোকা বানিয়ে তুমি খুব আনন্দ পেলে তাই না বাসুদেব বাবু?
বললাম-আমি বাসুদেব বাবু নই, আমি ইন্দ্রনীল বাবু বলছি।
-সে তো আমি জানি। কিন্তু গত কাল আপনি কোন এক মহিলাকে বাসুদেববাবু বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন, তাই না?
- এবার আমি ঘাবড়ে গেলাম। বুঝলাম- এই মহিলা আর কেউ নয় আমার স্কুল জীবনের প্রেমিকা মাধুরী। বললাম- মাধুরী, আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমাকে এত কাছে পেয়ে রসিকতা করার সুযোগ হাতছাড়া করিনি।
-মাধুরী ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে- তোমরা পুরুষরা বড় নিষ্ঠুর হৃদয়ের। নারীকে নিয়ে যা কিছু রসিকতা করতে তোমাদের বিবেকে বাধে না তাই না?
-বললাম- এমন করে বলো না মাধুরী। এ রকম বললে আমি খুব কষ্ট পাবো।
-আমাকে যে কষ্ট দিলে তার কি হবে?
-সেই জন্য তো আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমায় তুমি ক্ষমা করো।
-বিকেলে একটু বাজারের দিকে আসবে?
-কেন?
-তোমায় দু’চোখ ভরে দেখবো?
-ধেৎ, দেখার কি আছে। আমি যেমন ছিলাম ঠিক তেমন আছি।
-হোক, তবু আবার নতুন করে দেখবো। আর আসার সময় আমার সতীনকে আনতে ভুলো না। তাকেও দেখতে ইচ্ছে করছে। বলে ফোন কেটে দিল।
আমি অতীতের সেই দিনগুলির কথা ভাবতে ভাবতে আর একবার শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিলাম।
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
২২ শে জানুয়ারী,২০২১
দেবনগর।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.