#অভিযোজন

#গল্প

#অভিযোজন

#তারাপদ_মাঝি





#১#


গৌরী বেশ সমস্যায় পড়েছে। কলেজে পড়ার সময় তার কত স্বপ্ন ছিল যে যব করবে এবং তারপর বিয়ে করবে। কিন্তু বাধ সাধলো তার বাড়ন্ত শরীর আর সৌন্দর্য। বাবা কিছুতেই কলেজ শেষ করার পর আর পড়াতে চাইলেন না। নিজে টিউশান করে পড়বে বলাতে বাবা একেবারে রেগে তেলেবেগুনে জ্বলে গেলেন এবং মেয়ের সঙ্গে কথা বলে ছেড়ে দিলেন। বাধ্য হয়ে গৌরী বিয়ে করতে রাজি হলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে বাবা তাকে যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবেন তাকেই সে বিয়ে করবে।


একদিন গৌরীর বিয়ে হয়ে গেল। স্বামী আহামরি কিছু নয়। শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চমাধ্যমিক এবং পেশায় ব্যবসায়ী। চন্দননগরে একটি মাঝারী ধরনের কাপড়ের দোকান আছে। পরিবারে শ্বশুর শাশুড়ী, স্বামী বাদে বাকী দুই দেওর এবং একজন ক্লাস নাইনে পাঠরতা ননদ অর্থাৎ ছয় জনের সংসার। বাড়ির সবাই ভালো। কিন্তু শাশুড়ী বড্ড হিসেবী। কিছুতেই তিনি সংসারের হাল ছাড়তে নারাজ। বলতে গেলে তাঁর কথাতেই সংসার পরিচালিত হয়। যেহেতু গৌরী সংসারের প্রথম বউ এবিং বড় বউ, তাই তাকে নিজ হাতে গড়ে তুলতে চান সংসারের কতৃ হিসাবে।


প্রথম পাঠ শুরু হলো রান্না দিয়ে। গৌরীর সব চেয়ে এই ভয়টা বেশী ছিল। বাপের বাড়িতে সে খুব কম দিনই রান্না করেছে। তাতে সে কোন দিন ভাত পুড়িয়েছে, কোন দিন ফ্যান গালতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছে আবার কোন দিন মাছ ভাজতে গিয়ে মাছ পুড়িয়ে খাওয়ার অযোগ্য করেছে। এখন শ্বশুর বাড়িতে কি করবে তাই নিয়ে তার টেনশানের শেষ নেই।


দুপুরের রান্নার সময় শাশুড়ী রান্না করে দেখালেন কত কম তেলে মাছ ভাজা যায়। কত কম মসলা দিয়ে রান্না করা যায়। মসলার মধ্যে আহামরী কিছু নেই। নুন, হলুদ, লঙ্কা,পিঁয়াজ, জিরে আর সামান্য কিছু সরষের তেল। মোট তেলের পরিমান দশ থেকে পনের গ্রাম হবে বোধ হয়। এতেই দুটো বা তিনটে তরকারী রাঁধতে হবে। সব ঠিক আছে। কিন্তু ঐ টুকু তেল দিয়ে মাছ শো গ্রাম মাছ ভাজবে কি করে আর বাকি রান্না করবেই কি করে! এই ভাবতে ভাবতে গৌরীর দিন কেটে যায়।


স্বামী দেবতার নাম মহেশ্বর। তিনি রাত দশটায় বাড়ি এসে শুলেন। গৌরী তাকে বিশেষ আবদারে জড়িয়ে ধরলে। করুন অনুনয় করে বললে- শুনছো?

-বলো। মহেশ্বর বিশেষ আগ্রহ নিয়ে তাকালো।

-আমাকে না একটি জিনিষ এনে দিতে হবে।

-কি জিনিষ?

- এক কেজি সরষের তেল।

-কেন!

- কেন আবার? ঐ পনের গ্রাম সরষের তেল দিয়ে আমি পাঁচশো গ্রাম মাছ ভাজতে আর তিনটে তরকারী করতে পারবো না।

-ও, তাই? ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। ঐ তেলে তুমি যেমন পারবে তেমন করে রাঁধবে। কিন্তু আমার দ্বারা তেল আনা সম্ভব নয়। এক্ষুনি তেল এনে দিয়ে মা আমায় বকাবকি করবে।

-আরে ঐ টুকুন তেলে রাঁধলে যে আমি সব পুড়িয়ে ফেলবো। তখন যে কেএ খেতে পারবে না। আমায় যে সবাই বকাবকি করবে?

-কেউ বকবে না। আর বকলেই হলো! আমি আছি না!!! আমি মাকে ভয় করি ভক্তি করি। কিন্তু মা অন্যায় করলে সেটা সহ্য করবো না। তুমি ভয় পেয়ো না। তুমি যেমন পারো যেমন খুশি রান্না করো। খারাপ হলে কাউকে কিছু বলতে দেব না। আমি তোমায় পাশে আছি।

#২#


পরের দিন স্বামীর বাড়িতে গৌরীর প্রথম রান্না। তার আগেই তেল না দিয়ে কিভাবে শুধু জল ব্যবহার করে রান্না করা যায় বা কম তেল ব্যবহার করে কিভাবে রান্না করা যায় সে সব ইউটিউবে বার বার ভিডিও দেখে শিখে নিয়েছে। কিভাবে খুব অল্প তেলে মাছ ভাজা যায়, তা বেশ কয়েকবার ভিডিও দেখে মাছ ভাজা শিখে নিল। হাতে কলমে রান্না করতে গিয়ে দেখলো সত্যি খুব কম তেল দিয়ে ছোট ছোট চারা পোনাগুলো ভেজে নেওয়া গেল। পনের গ্রাম তেলের অর্ধেকও খরচ হলো না! সেদিন গৌরী ঝিঙে আর চারা পোনা দিয়ে ঝোল, চিংড়ী মাছ দিয়ে নটে শাকের চচ্চড়ি আর আমড়া দিয়ে মৌরালা মাছের টক বানালো। প্রত্যেকটি পদ চেখে চেখে নুন দিয়েছে বলে নুনের কম বেশীর বালাই নেই।ব্যঞ্জনগুলো হয়েছেও খাসা। বাড়ির সবাই খেয়ে বাহবা দিতে লাগলো।


সেই দিন বিকেল বেলা গৌরীর শাশুমা সিদ্ধেশ্বরীদেবী বাড়ীর চাবীর ছড়াটি গৌরীর আঁচলের খুঁটে বেঁধে দিয়ে বললেন- আমার দিন এবার শেষ মা। আমি এতদিন সংসার আগলে রেখেছি। আর আমি পারছি না। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে এবং আমি মনে করি তুমিই পারবে এই সংসারটা আগলে রাখতে। তাই সেই ভার তোমাকে দিলাম। আমাকে মুক্তি দাও। আমি এবার ঠাকুর দেবইতা নিয়ে রই।


গৌরী ভেবেছিল যে তার শাশুমা দজ্জাল হবে। কিন্তু শাশুমার এই ব্যবহারে তার চোখে জল এলো। সে তখনই তার শাশুমাকে প্রনাম করলো। শাশুমা তাকে দীর্ঘজীবী আর পরোপকারী হবার আশির্বাদ করলেন।


সেই দিন রাতের বেলা তরকারী রান্নার প্রায় কিছ নেই। কেবলমাত্র শ'তিনেক মৌরালা মাছ নুন হলুদ মাখিয়ে পড়ে আছে। এছাড়া আর কোন আনাজ তরিতরকারী নেই। গৌরী তার শাশুমাকে সব জানালো। তখন তার শাশুমা বললেন- মা, তোমার সংসার। আমারা তোমার ছেলে পুলে। তুমি যা রান্না করে খয়াবে তাই খাবো। আমি তো কিছুই বলবো। আর বাড়ীর কেউ কিছু বলবে না। এটাই এ বাড়ীর রীতি। বাড়িতে যা থাকবে, যা রান্না হবে তাই সকলে শান্তি মনে খাবে।


অগত্যা গৌরী ভাঁড়ারে গিয়ে দেখলো কি কি আছে। দেখলো বেশ কিছুটা ডাল আছে। এ বাড়ির কেউ ডাল পছন্দ করে না। তাই বোধ হয় ডাল অনেকটা পড়ে আছে। আলু আছে কিলো দেড়েক, সরষে তেল আছে শ'দেড়েক। তারপর একজায় গায় হাত মেরে দেখে অনেকটা কালো সরষে, পোস্ত শ'খানিক,তেজপাতা, গোটা শুকনা লঙ্কা, আর অনেকটা পাঁচ ফোড়ন আর জিরে। গৌরী তো আহ্লাদে আটখানা। শাশুমা কেন এগুলো ব্যবহার করেন নি কে জানে? রাতে সে রান্না করলো অল্প করে আলুর ভর্তা, আম ডালের ধাঁচে আমড়ার ডাল আর মৌরালা মাছের ভাপা।


সেদিন রাতে সবাই বেশ তৃপ্তি করে খেল। গৌরীর কাছ থেকে মৌরালা মাছের ভাপা কিভাবে রান্না হলো তা জানলেন এবং বড় ছেলেকে নির্দেশ দিলেন যা যা মসলা বউমা এনে দিতে বলবে তা যেন এনে দেওয়া হয়। কলকাতায় বাজার করতে যাবে বলে মহেশ্বর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লে। আর গৌরী উদাস হয়ে ভাবতে লাগলো- কি তার উদ্দেশ্য ছিল। আর কি হলো। বাপের বাড়িতে একরকম ছিল, আর এখানে আর এক রকম। নিজেকে ভেঙে চুরে নতুন ভাবে গঠন করতে হবে। কিন্তু আমার হেরে গেলে চলবে না। এখানে শিকড় পুঁতে তৈরী করতে হবে আমার স্বপ্নের মহিরুহ। এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় গৌরী ঘুমিয়ে পড়লো।


কপিরাইট@তারাপদ মাঝি

২৩শে জুলাই, ২০২১ 

দেবনগর।







কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.