#হাস্পাতালে_পরষ্পরের_কাছে_আসা

আমার তখন অচৈতন্য অবস্থা। আমার ভাইপো গোপালের অবস্থা তখন কতটা কঠিন ছিল এখন বুঝতে পারছি। আমি অপুত্রক পিতা। আমার একমাত্র ভরসা বা অবলম্বন যাই বলুন সে আমার ভাইপো গোপাল। আমার হার্ট অ্যাটাক হলো দোল পূর্ণিমার আগের দিন শনিবার ভোরে। সর্বত্র ডাক্তারের অভাব। অনেক ভেবে ভাইপো আমাকে ডায়মন্ডহারবার হাসপাতালে ভর্তি করালে।
আমার হুঁশ আছে, কিন্তু কিছু বলতে পারছি না। এমার্জেন্সি বিভাগ থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল মেল কোয়ার্টারের বেডে। বেডে নিয়ে যাওয়ার আগে মেডিসিন সেকশানে ট্রলিতে করে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে আমার বাম হাতে সেলাইন এবং ইঞ্জেকশান দেওয়ার জন্য স্টেশান বানাতে এক নার্স বালিকা আমার বাঁ হাত চাইলে। আমি আমার বাঁ হাত বাড়িয়ে দিতে উনি বিভিন্ন ডাক্তারী কেরামতিতে হাতে স্টেশান বানাতে উদ্দোগী হলেন। কিন্তু কিছুতেই হাতের শিরা খুঁজে পেলেন না। অনেক কষ্টে একটি জায়গায় সুঁচ ফুটালেন, কিন্তু স্টেশন বানানোর কাজটি করা গেল না। তখন পাশের একজন নার্স বালিকা ছুটে এলেন এবং খুব দক্ষতার সঙ্গে আমার হাতে স্টেশান বানিয়ে দিলেন। তারপর আমাকে একখানা ইঞ্জেকশান দিয়ে বেডে দেওয়া হল।
যে নার্স বালিকা আমার হাতে স্টেশান বানাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তিনি আমার প্রতি যেন একটু রুষ্ট হয়েছেন বলে মনে হল। কারণ তিনি পরের বার ওষুধ দিতে এসে আমাকে প্রথমেই অ্যাটাক করে বললেন- আপনি হাতটি মুঠো করেন নি কেন? ঐ জন্য তো আপনার হাতের ভেইনটা দেখতে পেলাম না। তাই স্টেশান বানাতে পারলাম না। আপনার কত কষ্ট হল বলুন তো!
আমি ততক্ষনে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে গেছি। আমার ঘিলুর প্যাঁচানো স্নায়ুগুলো আবার আগের মতো কাজ করতে শুরু করেছে এবং এতদিনের ধড়িবাজের অভ্যাসগুলো সে বিতরণ করতে শুরু করেছে। সেই অভ্যাস বশেই আমার মুখ থেকে তার প্রথম প্রশ্নবান ছুঁড়লো। বলল-আমার আহত হওয়ার জন্য আপনি কষ্ট পেয়েছেন না, কাজটি সঠিকভাবে না করতে পারার জন্য কষ্ট পেয়েছেন?
এই প্রশ্নটার জন্য বোধহয় উনি প্রস্তুত ছিলেন না এবং উনার প্রশ্নের আসল উত্তর যখন আমি জেনে ফেলেছি, তখন আমার কাছে আর থাকার প্রয়োজন বোধ করলেন না। একটু অসহিষ্ণু হয়ে চলে গেলেন। দেখলাম নার্স আমার উপর বেশ চটে আছেন। অন্তত তার শরীরের ভাষা তাই বলছে। আমি নার্সের দিকে তাকালাম। উচ্চতা খুব বেশি নয়।আন্দাজ চার ফুট আট নয় ইঞ্চি হবে বোধ হয়। খানিকটা স্থুলকায়া। গায়ের রং বেশ ফর্সা। তবে দেখতে কেমন হবে বলতে পারব না। বিবাহিতা না অবিবাহিতা তাও বোঝা যায় না। হিন্দু না মুসলিম তাও বোঝা মুশকিল। মুখ সর্বদা মাস্কে ঢাকা থাকে। মাথায় কোভিড ১৯ রোধক প্লাসটিক ক্যাপ আর হাতে গ্লাভস। কোন কিছু বিষয়ে কোন ভাবেই জানা সম্ভব না।
দেখা গেল চব্বিস ঘন্টায় আমাকে চার জন নার্স অ্যাটেন্ড করেন। তার মধ্যে আমার ঐ স্থুলকায়া নার্স(নাম দিলাম-মা করুনাময়ী) আর বাকী তিন জন। আমার ঐ করুনাময়ী ছাড়া বাকি তিনজন একেবারে নিয়মতান্ত্রিক। কোন বাড়তি কথা বলে না। কোন সু-পরামর্শ বা কু-পরামর্শের বালাই নেই। তারা সময়মত আসেন আর সময়মত চলে যান।যতক্ষন থাকেন ডাক্তারের সুপারিশ করা ওষুধ রোগীকে দেন এবং তারপর খাওয়ার নিয়ম বলে চলে যান। তাদের যদি বলা হয়-দিদি, বুকে শুধু যন্ত্রনা হচ্ছে, ডাক্তারকে একটু খবর দেওয়া যাবে? তারা কোন উত্তর না দিয়ে কেমন একটা মুখ করে চলে যেত। কিন্তু করুনাময়ীকে এ কথা বললে তিনি রোগীর কাছে এসে সব কিছু জিজ্ঞাসা করে ডাক্তারকে খবর দিয়ে আনাত। কিন্তু ঐ নার্স আমার কাছে এলে আমার কাছে এক বিন্দু দাঁড়াতেন না।
এক দিন পর দেখলাম নার্স মা করুনাময়ী আমার কাছে এসে আমার সব কিছু খোঁজ নিলেন। ব্যাপারটা কি হলো বুঝতে পারলাম না। আমি অবাক হয়ে যখন উনার দিকে তাকালাম, উনি বললেন- আপনাকে তো ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। তবুও কি আপনার ঘুম আসে না?
-বললাম- না, বেশ ভালো ঘুম হয়েছে। রাত ১০ টায় ঘুমিয়েছিলাম। একেবারে ৬টায় ঘুম ভেঙেছে।
-মোবাইল বেশী ঘাটা ঘাটি করবেন না। এতে মাথায় এক রকম ট্রেস পড়বে আর তার থেকে টেনশান হতে পারে। আর টেনশান আপনার রোগের ক্ষেত্রে খারাপ। এই বয়সে এখনও ফেসবুক করেন?
-বুঝলাম, ঘুমের সময় উনি আমার মোবাইল দেখে ফেলেছেন! এই অসুস্থ অবস্থায় আমি ফেসবুকের গল্পের সম্ভারকে বিনোদনের জন্য বেছে নিয়েছিলাম। তবে কখন যে উনি এসে আমার মোবাইল দেখলেন বুঝতে পারিনি।
- আমার এই সন্দেহ উনি দূর করলেন। উনি বললেন- “কাল আমার নাইট ডিউটি ছিল। আমি আপনার কাছে যেতেই দেখলাম আপনার বুকের উপর মোবাইল পড়ে থাকতে। আপনার দেখা শোনা করার জন্য যে ছিল, তাকে বললাম মোবাইল সরিয়ে রাখতে। মোবাইলের ভাইব্রেশান যদি থাকে, তাহলে ঘুমন্ত অবস্থায় হলেও হার্টের ক্ষতি করবে।
-তখন আপনার ছেলে বলে- মোবাইল সরানো যাবে না। উনি জেগে উঠে মোবাইল না পেলে চেঁচামেচি করবেন।
-মোবাইল নিয়ে কি এত করেন উনি?
-কি করেন না তাই বলুন!
-মানে?
-এই মোবাইল হলো উনার প্রান। কখনো মোবাইলে কবিতা গল্প লেখেন এবং পড়েন, কখনও গান শোনেন, আবার কখনো শেয়ার বাজারের উঠা পড়া দেখেন। এক মুহূর্ত উনি মোবাইল ছাড়া থাকতে পারেন না।”
উনার কাছে থেকে এসব শোনার পর আমি বেশ লজ্জা পেলাম। আমার শেয়ার বাজারের কথা জানুক, গল্প পড়ার কথা জানুক তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু এই গল্প বা কবিতা লেখার বিষয়টা জেনে যাওয়ায় বেশ লজ্জা পেলাম। তখন বাধ্য হয়ে বললাম- মা, কবিতা বা গল্প লেখা আমার পেশা নয়। এক রকম নেশা বলতে পারো। তবে যেগুলো লিখি, সেগুলো গল্প বা কবিতা বলার যোগ্য কিনা আমার জানা নেই। আর লিখি এই জন্য যে প্রত্যেকটি গল্প বা কবিতা আমার জীবনের প্রত্যক্ষভাবে কিছু না কিছু জড়িত। সেই স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য কবিতা বা গল্প লিখি। এতে কেউ আনন্দ পাক বা না পাক আমার কিছু আসে যায় না।
“মা” ডাক শোনা মাত্র যে কোন নারী দুর্বল হয়ে পড়েন। এটা আমি অনেক সময় পরখ করে দেখেছি।এখানেও সেই অস্ত্র প্রয়োগ করেছি এবং যথারীতি তার ফল পেতে শুরু করেছি।
-সবাই সিস্টার বলে আমাদের ডাকে। আপনি “মা” বললেন কেন? করুনাময়ী জিজ্ঞাসা করলেন।
-আমি বললাম- প্রত্যেকটি নার্স সেবা কাজে ব্রতী। সেক্ষেত্রে সবাই মা টেরেসার মতো সেবা ধর্মী। তাই সকল নার্সকে আমি “মা” বলে সম্বোধন করতে পারি। তাছাড়া কতই আর আপনার বয়স হবে? খুব বেশী হলে একুশ বছর। আমার বড় মেয়ের বয়স তেইশ বছর। সুতরাং তোমায় “মা” বলে ডাকলে নিশ্চয় অখুশি হবে না।
- এবার করুনাময়ী জব্দ। বললে- আপনি পিতৃতুল্য। আপনি যে নামে খুশি ডাকুন। আমার কোন অসুবিধা নেই।
এর পর দিন থেকে দেখি করুনাময়ী আমার গল্প পড়ে মন্তব্য করতে শুরু করেছে। আমি মেসেঞ্জারে ওকে ধরলাম। বললাম- গল্প পড় কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু মন্তব্য করো না। মন্তব্য করতে গেলে মেসেঞ্জারে করো। কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরলে হাসপাতালের গল্প লিখতে গিয়ে ঘুরে ফিরে তোমার কথা আসবে। তারপর তোমার মন্তব্য দেখে তোমার স্টেটাস দেখবে। তারপর আমার বন্ধুরা তোমায় ট্রেস করে বিভিন্ন রকম মন্তব্য করতে পারে। তাতে তোমার এবং তোমার কর্মক্ষেত্রের পক্ষে ভালো নাও হতে পারে।
আমার কথা শোনার পর করুনাময়ী মন্তব্য করা বন্ধ করল এবং যে মন্তব্যগুলো করেছিল, সেগুলি তাড়াতাড়ি মুছে দিল।
রবিবার ভর্তি হয়েছিলাম। ছুটি পেলাম শুক্রবার বিকালে। ওইদিন সকালের পর রাতের ডিউটি আছে করুনাময়ীর। তাই সকালের ডিউটি সেরে বাড়ি যাওয়ার সময় আমার কাছে এসে বলল -আপনি আজ রিলিজ পাবেন। আমি রাত আটটায় আবার জয়েন করবো। আমায় কিছু ফল দিয়ে বললে- এগুলি খাবেন। নিজের মেয়ে মনে করে আমার ভুল হলে ক্ষমা করবেন। এই সময় তার চোখ জলে ভিজে যেতে দেখলাম।
-বললাম- মা, কোন চিন্তা করো না। আমি যে বাবা। সব কিছু সহ্য করার ক্ষমতা আমার আছে। আর তুমি কোন দোষ বা ভুল করো নি। সুতরাং তোমার দুঃখ করার কিছু নেই।
-আসলে তুমি মানুষটা কিন্তু একটু অন্য রকম। তোমাকে বাহির থেকে দেখলে মনে হয় তুমি লোকটা বড় কঠিন, বড় খারাপ মানুষ। কিন্তু মিশলে বোঝা যায় সম্পুর্ন ভিন্ন রকমের। আরও কিছু দিন যদি তোমার সান্নিধ্য পেতাম!
-তাহলে আমি আবার অসুস্থ হওয়ার ভান করি। তাহলে আরও কিছুদিন এখানে থাকা যাবে। আমি রসিকতা করে বললাম।
এতক্ষন আমাদের বাপ মেয়ের কথা বার্তা শুনছিল পাশের পেসেন্টরা। তাদের মধ্যে হৃষিকেশদা বললে-মা,ঠিক কথা বলেছেন দাদা। আপনাকে বাহির থেকে বোঝা দায়। মিশলে বোঝা যায় তুমি কেমন মানুষ।
আমার সঙ্গে মিনিট দশেক কথা বলার পর আমার ভাই এলো। প্রথম তিন দিন ভাইপো থাকার পর আমার ভাই শক্তিপদ আমার কাছে এলো। সে আমার জন্য হোটেল থেকে ভাত এনেছে এবং তাড়াতাড়ি স্নান সেরে খেয়ে নিতে বলায় করুনাময়ী আমায় বিদায় জানিয়ে চলে গেল।
শুক্রবার বিকাল পাঁচটায় গাড়িতে উঠলাম। সহ রোগীদের বিদায় জানিয়ে যখন নার্সদের করিডোর অতিক্রম করে ফিরছি, তখন এক নার্স এসে আমার হাতে একটি চিরকুট দিয়ে বললে- “আপনার করুনাময়ী দিয়েছে।”
বাড়িতে যাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরতে পারলাম না। আমি যা অনুমান করেছি, তাই ঠিক কিনা জানার জন্য মনটা ছটফট করতে লাগলো। গাড়িতে বসেই চিরকুটটা পড়তে লাগলাম। চিরকুটে লেখা-
“শ্রদ্ধেয় স্যার,
পত্রে আমার প্রনাম নেবেন। আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারেন নি। আমি আপনার স্নেহের ছাত্রী অর্পিতা(নাম পরিবর্তিত)। আমিও প্রথমে আপনাকে একেবারেই চিনতে পারি নি। আপনার কলেজ জীবনের ছবি থেকে এখন আপনি সম্পুর্ন অন্যরকম দেখতে হয়ে গেছেন। ফেসবুকে আপনার সেসব ছবি দেখেই চিনতে পেরেছি। প্রথমে আপনার সঙ্গে আমি রুঢ় ব্যবহার করে ফেলেছি। আমায় ক্ষমা করবেন।
ইতি
আপনার প্রিয় ছাত্রী
অর্পিতা।”
আমি কুচি কুচি করে চিরকুটটা ছিঁড়ে বাইরে ফেলে দিলাম। বুঝলাম হার্ট অ্যাটাক হলেও, আমার ব্রেন অ্যাটাক এখনও হয় নি।
(এই গল্পে করুনাময়ী তথা অর্পিতা নার্সের চরিত্রটি সম্পুর্ন কাল্পনিক। নেহাত গল্পের প্রয়োজনে এই চরিত্রটি চিত্রন করা হয়েছে। বাস্তবে করুনাময়ী বা অর্পিতা বলে কোন নার্সের অস্তিত্ব নেই)
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
দেবনগর
৯ই এপ্রিল,২০২১।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.